Home অপরাধ ফেসবুকে প্রতারণার নানা ফাঁদ (পর্ব-৪)

ফেসবুকে প্রতারণার নানা ফাঁদ (পর্ব-৪)

by Amir Shohel

সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুকে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র। বিভিন্ন মর্যাদাপূর্ণ ও জনপ্রিয় ব্যক্তিদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে অথবা ফেইক আইডি তৈরী করে চলছে এসব ফেসবুকে ফেক আইডি রীতিমতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। ভুয়া আইডি দিয়ে প্রতারণার বিষয়টি এখন এমন এক স্তরে পৌঁছেছে যে ভুক্তভোগীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা-বিটিআরসি’র দ্বারস্থ হচ্ছেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সম্প্রতি নাটোর থেকে প্রতারক চক্রের ১১ জন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। এরা ভুয়া আইডি কার্ডে সুন্দরী নারীর ছবি লাগিয়ে যুবকদের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। কেউ কেউ প্রতারক চক্রের দ্বারা সর্বশান্ত হয়েছে। এই চক্রের সঙ্গে শুধু যুবক নয়, অনৈতিক কাজে যুবতীরাও জড়িত।

পুলিশের এক কর্মকর্তা বললেন, ভুয়া আইডিতে এরা সাধারণত নামের শেষে ‘আক্তার’ শব্দটি ব্যবহার করে। যেমন সোমা আক্তার, শেফালি আক্তার, রুপালি আক্তার, সালমা আক্তার, বিউটি আক্তার, খালেদা আক্তার, লায়লা আক্তার এবং সেলিনা অক্তারসহ আরো অনেক নাম রয়েছে। এ ছাড়া নীল কষ্ট, হৃদয় ভাঙা মন, কত যে কষ্ট, মন মানে না- এমন ধরনের নানা বাক্য ব্যবহার করে আইডিতে। এসব দেখলেই বুঝতে হবে প্রতারক চক্রের ভুয়া আইডি এটি। তাই এদের থেকে সাবধান হতে হবে।

ফেক ফেসবুক আইডি নিয়ে প্রায়ই বিড়ম্বনার শিকার হন বিভিন্ন জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও অভিনয়শিল্পীরা। একজন অভিনেত্রী নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে বলেন, ‘তার নামে অন্তত ২০-২৫টি ফেসবুক আইডি খোলা হয়েছে। থানায় জিডি করে ও র‌্যাবের কাছে অভিযোগ করে ৮-১০টি আইডি বন্ধ করাতে পেরেছেন তিনি। এর মধ্যে দুটো আইডিতে তার ফোন নম্বর ব্যবহারসহ অশ্লীল কথাও পোস্ট করা হয়। তিনি ও তার পরিবার এতে ভীষণ সমস্যায় পড়েছে।

দেশের গুরুত্মপুর্ণ মন্ত্রীদের নামেও রয়েছে ফেক আইডি। প্রতিনিয়ত এই চক্রের সদস্যরা গ্রেফতার হলেও মিলছে না সুরাহা। ক্লিন ইমেজের রাজনীতিবিদ শিক্ষামন্ত্রী ড. দিপু মনির নাম এবং ছবি ব্যবহার করে ফেক আইডি খুলে প্রতারণার খবর।

শিক্ষামন্ত্রীর নামে ফেসবুক আইডি খুলে প্রতারণার অভিযোগে চাঁদপুরে ৩ কলেজ শিক্ষককে গত সোমবার রাতে ফরক্কা কলেজ থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

পুলিশ জানায়, দীর্ঘদিন ধরে সদর উপজেলার ফরক্কা কলেজের একটি কক্ষ ব্যবহার করে শিক্ষামন্ত্রী ডাক্তার দীপু মনির নামে ভুয়া ফেসবুক আইডি খোলাসহ সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নাম ব্যবহার করে প্রতারণা চালিয়ে আসছিলেন তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক শিক্ষক নোমান সিদ্দিকী ও ইসলামের ইতিহাসের শিক্ষক জাহাঙ্গীর হোসেনসহ ৩ শিক্ষক।

এ ঘটনায় আবদুল মান্নান নামে স্থানীয় এক স্কুলশিক্ষক আইসিটি আইনে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করলে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। পরে কলেজের আইটি রুম থেকে হাতেনাতে ৩ শিক্ষককে গ্রেফতার করে পুলিশ।

ফেসবুকে প্রতারকদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না সাংবাদিকরাও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক এখন ভয়ঙ্কর ফাঁদের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে অপরাধীরা। ফেক আইডি খুলে সম্মানি লোকের সম্মানহানি করা হচ্ছে অবলীলায়। ইদানীং অনলাইন কেনাকাটার নামেও হচ্ছে প্রতারণা। প্রতিদিনের ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা জানাজানিও হচ্ছে। এরপরও মানুষ প্রতারকের খপ্পরে পড়ছে। আটকে যাচ্ছে প্রতারণার জালে।

এভাবে সাংবাদিকদের নাম এবং ছবি ব্যবহার করে ফেক আইডি খুলে চাকরী দেয়ার কথা বলে প্রতারকরা হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার টাকা। এ বিষয়ে সতর্কতামূলক পোস্ট দেয়ার পরও থামছে না প্রতারকদের দৌরাত্ম। প্রতিনিয়তই তারা নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে হাতিয়ে নিচ্ছে অর্থ। এতে প্রতারিতরা হচ্ছে স্বর্বশান্ত।

ফেসবুকের মেসেঞ্জারে কেউ টাকা চাইলে তার পরিচয় আগে নিশ্চিত হয়ে নিন। এখন সাইবার দুর্বৃত্তরা ফেসবুকে প্রতারণার ফাঁদ পেতে রেখেছে। সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে ঘনিষ্ঠ ও পরিচিতজনের ছদ্মবেশে ফেসবুক মেসেঞ্জারে টাকা চাওয়ার হার বেড়ে গেছে। ফেসবুকের এই স্ক্যাম ব্যবহারকারীদের মধ্যে উদ্বেগও তৈরি করেছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের রয়েছে সাইবার ক্রাইম ইউনিট। তারা অভিযোগ গ্রহণের পর সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আবার ফেসবুকে রয়েছে সাইবার ক্রাইম ডিভিশন ফেসবুক পেজ। এ পেজের মাধ্যমেও অভিযোগ করা যাবে। সাইবার ক্রাইম ডিভিশনের এক কর্মকর্তা বলেন, সংশোধিত তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ (১) ধারা লঙ্ঘন করলে ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান আছে। ১ কোটি টাকা জরিমানাও হতে পারে। কেউ ভুয়া আইডির কারণে প্রতারণার শিকার হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে যেতে পারেন।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, ফেসবুকের অপরাধ নিয়ে তদন্তের সক্ষমতা বাড়ছে। তবে ফেসবুকের সঙ্গে সরাসরি কাজ করে এমন একক কোনো সংস্থা নেই পুলিশ প্রশাসনে। এ ব্যাপারে কোনো সমন্বিত তথ্যও নেই। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের সাইবার ইউনিট, পুলিশ সদর দপ্তরের এলআইসি সেল, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন, বিশেষ শাখা-এসবি ও র্যাযব সাইবার ক্রাইম নিয়ে আলাদাভাবে কাজ করছে।

এদিকে, র‌্যাব ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে প্যাট্রলিংয়ের জন্য ‘সাইবার নিউজ ভেরিফিকেশন সেন্টার’ চালু করেছে। সেখানে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হয় বলে জানান র‌্যাবের একজন উর্দ্ধতন কর্মকর্তা।

ফেসবুকের সবচেয়ে বেশি অভিযোগ সিটিটিসির সাইবার ক্রাইম ইউনিটে। গত এক বছরে কয়েক হাজার অভিযোগ এসেছে সেখানে। সাইবার ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, অভিযোগ পেলে নির্দিষ্ট চ্যানেলে তদন্ত হয়। ফেসবুকের সঙ্গে সরাসরি তথ্য আদান-প্রদান করেও তদন্ত চলছে।

গত বছর সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় উঠে আসে, দেশে সাইবার অপরাধের শিকার ৫১.১৩ শতাংশ নারী এবং ৪৮.৮৭ শতাংশ পুরুষ। গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ভুয়া আইডির মাধ্যমে হয়রানির শিকার হন ১৪.২৯ শতাংশ নারী এবং ১২.৭৮ শতাংশ পুরুষ। ছবি বিকৃতির শিকার হন ১২.৩ শতাংশ নারী এবং ৩.৭৬ শতাংশ পুরুষ। অনলাইনে হুমকির শিকার ৯.৭ শতাংশ নারী এবং পুরুষ ৩.৭৬ শতাংশ।

ওই গবেষণায় উঠে আসে, ভুক্তভোগী অনেকেই আত্মমর্যাদা ধরে রাখতে ঘটনা চেপে যান। যাঁরা অভিযোগ করেন তাঁদের মধ্যে হাতে গোনা ব্যক্তি সুফল পেয়েছেন। অভিযোগ করার কারণে অনেকে হয়রানির মুখেও পড়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তারকাদের ফেসবুক আইডি ‘ভেরিফায়েড’ হলে তাতে ‘ব্লু ব্যাজ’ দেয়া থাকে। ভুয়া আইডিতে ব্যাজ থাকে না, থাকে বহুল ব্যবহৃত পুরনো ছবি, অন্য আইডি বা পেজের ছবি। তারকাদের ওয়ালে হালনাগাদ তথ্য না থাকলেও সেটি ভুয়া আইডি হওয়ার আশঙ্কা আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইডির ‘অ্যাবাউট’ অপশনে গিয়ে ই-মেইল বা অন্য যোগাযোগ, ঠিকানা, ফ্যামিলি ফ্রেন্ড এবং শিক্ষাগত যোগ্যাতার সূত্র থেকেও আইডি সঠিক কি না তা সহজে বোঝা যায়। ভুয়া আইডিতে এসব থাকে না। ভুয়া আইডির ব্যাপারে ফেসবুকেই রিপোর্ট করারও সুযোগ আছে।

হ্যাক বা ফেক আইডি থেকে বাংলাদেশিদের বাঁচাতে ফেসবুকে পুলিশের পেইজ থেকে দেয়া হয়েছে বিশেষ নির্দেশনা। চলুন জেনে আসি কী আছে তাতে!

যে কোন ধরনের প্রতারণা রোধে বাংলাদেশ পুলিশ সদা সক্রিয় জানিয়ে, গত সোমবার একটি ছবিতে কিছু নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ। ওই ছবিতে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সন্দেহভাজন প্রতারকদের চিহ্নিত করতে এবং সংগঠিত প্রতারণার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতারকদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশের মাঠপর্যায়ের বিভিন্ন ইউনিট। প্রতিনিয়ত আইনের আওতায় আনা হচ্ছে এ ধরণের প্রতারকদের।

সাইবার অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ বলেন, শুধুমাত্র আইন প্রয়োগ করে এ ধরনের অপরাধ সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা খুব সহজ নয়। এক্ষেত্রে, সামাজিক সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে অনলাইন কেন্দ্রীক আর্থিক লেনদেনে না জড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।

ভয়েসটিভি/এএস

You may also like