Home জাতীয় বাউল মতবাদ ও আবিস্কারক রবীন্দ্রনাথ ভাবনা

বাউল মতবাদ ও আবিস্কারক রবীন্দ্রনাথ ভাবনা

by Newsroom

রনজক রিজভী :

সাহিত্য সৌধের কালজয়ী এক প্রতিভার নাম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আজ তাঁর ১৫৯তম জন্মজয়ন্তী। তিনি নিজেকে কেন্দ্রবিন্দু করেই ঘুরেছেন সাহিত্যাঙ্গন। একারণে নিজের উদাহরণ হয়েছেন নিজেই। এই মহাপুরুষের সাহিত্য সাধনার স্থান অনেকগুলো থাকলেও সাহিত্যতীর্থ ছিল একটাই। কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহ। এখানে এসে তিনি বাউল ভাবনার সহজ মানুষসহ পেয়েছেন গ্রামীণ জীবনের ছোঁয়া। এখানকার সুর বৈচিত্র আর ভৌগলিক প্রেক্ষাপটেই তিনি হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রবাউল।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বাউল মতবাদের একটি সুনিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে শিলাইদহে। তিনি বাউল গানের ভাব-সাধন এখান থেকেই উলোটপালোট করে দেখেছেন। জেনেছেন বাউলদের সম্পর্কেও। সংগ্রহ করেছেন বাউল গান। আর এই বাউল গানের সুর ও ভাব তাঁকে কখন আকৃষ্ট করেছিল, তিনি নিজেও বুঝতে পারেননি। যার প্রভাব তাঁর বেশ কিছু গানে রয়েছে। এনিয়ে কেউ-কেউ বিভ্রান্তিকর কথা বললেও রবীন্দ্রসমুদ্র সম্পর্কে তাদের জানার সীমাবদ্ধতাই প্রকাশ পায়। বাউল মতবাদে আকৃষ্ট হওয়ার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ যে একজন বড় মাপের আবিস্কারক, এ প্রমাণও তিনি দিয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৬১ সালে। তখন লালন ফকিরের আনুমানিক বয়স ৮৭ বছর। রবীন্দ্রনাথ আশি বছর তিন মাস বয়সে ২২ শ্রাবন ১৩৪৮ সালে (৭ আগষ্ট ১৯৪১) পরলোকগমন করেন। আর লালন ১৮৯০ সালে ১৭ অক্টোবর প্রায় একশত ষোল বছর বয়সে দেহত্যাগ করেন। তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ত্রিশ বছর। এই সূত্রে বলা যায়, জমিদারীর কারণে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে এসে লালন ফকিরকে জেনেছিলেন। যখন লালন ফকির জীবিত ছিলেন। যা তিনি শিলাইদহে না এলে এই সুযোগ পেতেন না। তাঁর প্রাণধর্মের প্রেরণা আর বাউলের প্রেরণার উৎস ছিলো অভিন্ন। তাই বাউলের ‘মনের মানুষ’ তত্ত্বের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনদেবতা’র একটি ঐক্য ও সাযুজ্যবোধ সহজেই আবিস্কার করা সম্ভব। বাউলগানের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মানববাদী জীবনচেতনার প্রেরণা অনুভব করেছিলেন। একারণে নিজে রবীন্দ্র বাউল বলেও ভেবেছেন।

জমিদারী পরিচালনার সূত্রে শিলাইদহে এসে রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন বাউল-ফকির ও বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীর সংস্পর্শে আসেন। এখানেই বাউলগানের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ পরিচয় ঘটে। এই শিলাইদহেই বাউল-সংস্পর্শ লাভের বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘হারামণি’র ভূমিকায় নিজেই বলেছেন: ‘শিলাইদহে যখন ছিলাম, বাউলদের সঙ্গে আমার সর্ব্বদাই দেখাসাক্ষাৎ ও আলাপ আলোচনা হ’ত। আমার অনেক গানেই বাউলের সুর গ্রহণ করেছি। এবং অনেক গানে অন্য রাগরাগিনীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞতসারে বাউলসুরের মিল ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে, বাউলের সুর ও বাণী কোন এক সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে। আমার মনে আছে তখন আমার নবীন বয়স, Ñশিলাইদহ অঞ্চলেরই এক বাউল কলকাতায় একতারা বাজিয়ে গেয়েছিল, ‘কোথায় পাব তারে/ আমার মনের মানুষ যে রে/ হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে/ দেশ বিদেশ বেড়াই ঘুরে।’

লালন-শিষ্যদের সঙ্গে শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের দেখাসাক্ষাৎ ও দীর্ঘসময় আলাপ আলোচনা হয়েছে, এ-কথা তিনি কালীমোহন ঘোষের সঙ্গে আলাপচারিতায় নিজেই উল্লেখ করেছেন। লালন-শিষ্যদের মধ্যে পাঁচু শাহ, শীতল শাহ, ভোলাই শাহ, মলম শাহ, মানিক শাহ ও মনিরদ্দীন শাহ শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবির কাছে যাতায়াত করতেন বলে জানা যায়। কুঠিবাড়ির সঙ্গে ছেঁউড়িয়ার আখড়ার একটি অন্তরঙ্গ সম্পর্কও হয়েছিল।

শিলাইদহ পোস্ট-অফিসের ডাকহরকরা বাউলকবি গগন হরকরাকে রবীন্দ্রনাথই আবিষ্কার করে দেশ-বিদেশে পরিচিত করেন। বাউলগান রচয়িতা ও সুগায়ক হিসেবে তার বিশেষ খ্যাতি ছিলো। সেই সুবাদে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা ছিল। গগনের থেকেই তিনি বিভিন্ন সাধকের বাউলগান শোনার সুযোগ পেয়েছিলেন। রবীন্দ্রমানসে বাউলচেতনা সঞ্চারের মূলে রয়েছেন লালন ফকির ও গগন হরকরা। বাউলতত্ত্ব ও দর্শন সম্পর্কে তাঁর ধারণা-গঠনে গগনের ‘আমি কোথায় পাব তারে’ গানটির ভূমিকা খুবই স্পষ্ট।

শিলাইদহে গগন হরকরা, কাঙাল হরিনাথ, গোঁসাই রামলাল, গোঁসাই গোপাল, সর্বক্ষেপী বোষ্টমী ও লালনের শিষ্যসম্প্রদায়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা-সাক্ষাৎ ও আলাপ-আলোচনা হয়েছে। শিলাইদহ ও ছেঁউড়িয়া-অঞ্চল থেকে সংগৃহীত লালন ফকির ও গগন হরকরার গান তিনি সুধীসমাজে প্রচার করেন। একই সঙ্গে বাউলগান-রচয়িতা কুমারখালীর সাধক কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের (১৮৩৩-১৮৯৬) সঙ্গেও রবীন্দ্রনাথের আলাপ-পরিচয়ের কথা জানা যায়। তবে রবীন্দ্রনাথের পিতামহ ও পিতার সময়ে শিলাইদহে প্রজা-পীড়নের কথা হরিনাথ ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকায় প্রকাশ করে ঠাকুর-পরিবারের বিরাগভাজন হন। এইসব কারণে উভয়ের মধ্যে খুব একটা সহজ সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারেনি। এরপরও কাঙাল হরিনাথ প্রতিষ্ঠিত কুমারখালী মথুরানাথ মুদ্রাযন্ত্রের বাংলা ১৩০৭ সনের পত্র-নকল খাতার ২২০ নং পত্রে (১০ পৌষ ১৩০৭) জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ হরিনাথের বাউলগীতি-গ্রন্থসহ অন্যান্য কয়েকটি গ্রন্থ সংগ্রহ করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের পরিচিত শিলাইদহ গ্রামের বাউলসাধকদের মধ্যে গোঁসাই রামলাল (১৮৪৬-১৮৯৪) ও গোঁসাই গোপালের (১৮৬৯-১৯১২) নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই দুই সাধকের সাধনপীঠও শিলাইদহ গ্রাম, কবির কুঠিবাড়ির খুব কাছে। গোঁসাই রামলালের সঙ্গে অবশ্য কবির পরিচয় দীর্ঘ হতে পারেনি। সুকণ্ঠ গোঁসাই গোপালের সাধনতত্ত্ববিষয়ক সঙ্গীতের অনুরাগী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। মাঝে-মধ্যে তিনি কুঠিবাড়িতে গোপালকে আমন্ত্রণ জানাতেন গান শোনার জন্য। শোনা যায় রবীন্দ্রনাথ গোঁসাই গোপালেরও কিছু গান সংগ্রহ করেছিলেন। এভাবে তিনি অনেককেই মূল্যায়ন করেছেন এবং অনেকের সাহিত্যকর্ম সংগ্রহও করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁকে আবিস্কারক বলা যেতে পারে। তাঁর সংগ্রহশালা থেকে এঅঞ্চলের অনেক গুণীজনকে সনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।

You may also like