Home সারাদেশ ব্যতিক্রমী রায়ে ৭০ শিশুকে মা-বাবার জিম্মায় দিলেন আদালত

ব্যতিক্রমী রায়ে ৭০ শিশুকে মা-বাবার জিম্মায় দিলেন আদালত

by Amir Shohel

ছোটখাটো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে চুরি বা মারামারির মামলায় কেউ কেউ জেল খেটেছে। আবার কাউকে হাজিরা দিতে হতো আদালতে। অপরাধী হিসেবে হাজিরা দেওয়ার সময় শিশুদের যেমন মন খারাপ হতো অভিভাবকরাও তেমন বিব্রত ও লজ্জ্বিত বোধ করতেন। জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে আদালত এমন ৭০ শিশু অভিযুক্তদের সংশোধনের জন্য বাবা মা’এর কাছে ফেরত পাঠালেন। বিচারকের নির্দেশে ওদের হাতে বাংলাদেশের পতাকা, ফুল আর ডায়রি তুলে দিলেন আদালতের কর্মীরা।

২১ মার্চ সোমবার দুপুরে সুনামগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল এবং শিশু আদালতের বিচারক মো. জাকির হোসেন এই ব্যতিক্রমী রায় দেন।

মামলা থেকে জানা যায়, বিভিন্ন সময়ে দায়ের হওয়া ৫০টি মামলায় ৭০ জন শিশু আদালতে এসে হাজিরা দিতে হতো। মারামারি, ছোটখাটো চুরির অভিযোগ আনা হয়েছিল এদের বিরুদ্ধে। কোমলমতি এসব শিশুরা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠতে অনিশ্চিয়তার মধ্যে পড়ে। শিক্ষাজীবন ব্যাহত হবার উপক্রম হয়। আদালত এই শিশুদের কারাগারের পরিবর্তে মা-বাবার জিম্মায় ফেরত পাঠিয়ে শিশুদের জীবন সুন্দর ও মানবিক গুণাবলি নিয়ে বেড়ে ওঠার জন্য সংশোধনের শর্ত দিলেন।

শহরের নর্থ ইস্ট আইডিয়াল কলেজের এক শিক্ষার্থী বলেন, কলেজের পাশের বিসিক মাঠে মারামারি হয়েছিল। বন্ধুদের সঙ্গে আমি ওখানে গিয়েছিলাম। মারামারিতে আমি যুক্ত হইনি। কিন্তু মামলার আসামি হওয়ায় দেড় বছরে ২৫ বার আদালতে হাজিরা দিতে এসেছি। হাজিরার দিনে মন খারাপ হতো। কলেজে ক্লাস থাকলেও হাজিরায় গিয়েছি। আদালত আমাকে সংশোধনের জন্য মা-বাবার জিম্মায় দেওয়ায় আমি খুশি। আমাকে যে শর্ত পালনের জন্য বলা হয়েছে। আমি সেটি করবো। ডায়রিতে লিখে রাখবো।

জেলার জগন্নাথপুরের চিলাউড়া নয়াপুঞ্জি এলাকার এক কিশোর একবছর আগে মারামারি মামলায় আসামি হয়ে ৬-৭ বার হাজিরা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ কাম কাজ কইরা খাই, গাঁওয়ে মারামারি অইছে হকলের লগে আমারেও আসামি দিছে, যেদিন হাজিরা দিতে আইতাম, ইদিন আর কামও যাইতাম পারতাম না, আইলেতো খরচও লাগে, মা-বাপ বড় বেশি চিন্তাত আছলা, আজকে জজ সাবে মুক্তি দিছইন, তানরা যে লাখান চলার কথা কইছইন ইলাখানঔ চলমু, এক বছর পরে আইয়া ডায়রি দেখাইমু।’

আদালতের দেওয়া শর্তাবলির মধ্যে রয়েছে— নিয়মিত পড়াশুনার পাশাপাশি প্রতিদিন কিছু ভাল কাজ করা এবং ডায়েরিতে তা লিখে রাখা, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানা, সবার সাথে ভাল ব্যবহার করা, বাবা-মাসহ গুরুজনদের আদেশ নির্দেশ মেনে চলা এবং বাবা মায়ের সেবা যত্ন করা ও কাজে কর্মে তাদের সাহায্য করা, নিয়মিত ধর্মগ্রন্থ পাঠ করা এবং ধর্মকর্ম পালন করা, প্রত্যেকে কমপক্ষে ২০টি করে গাছ লাগানো এবং গাছের পরিচর্যা করা, অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করা, মাদক থেকে দূরে থাকা এবং ভবিষ্যতে কোন অপরাধের সঙ্গে নিজেকে না জড়ানো।

এসব শর্ত প্রতিপালিত হচ্ছে কি না তা প্রবেশন কর্মকর্তা মো. শফিউর রহমান পর্যবেক্ষণ করবেন এবং প্রতি তিনমাস অন্তর অন্তর আদালতকে অবহিত করবেন।

শফিউর রহমান বলেন, এই ধরনের রায় যুগান্তকারী, এর মাধ্যমে শিশুদের সংশোধন হবার সুযোগ হলো। এই সময়ে তাদের আচার আচরণ পর্যবেক্ষণ করে আদালতকে রিপোর্ট জানাব।

জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট রবিউল লেইছ রোকেস বলেন, এই রায়ের ফলে ছোট খাট অনেক মামলার দীর্ঘসূত্রিতার অবসান হল। শিশুরা তাদের আপন ঠিকানা ফিরে পেল। আদালত প্রাঙ্গণে আসা থেকে রেহাই পেলো। আদালতের শর্ত মেনে চললে অবশ্যই শিশুটি সংশোধিত হবে।

ব্যতিক্রমী রায়ের দিনটি স্মরণিয় ও ইতিহাস হয়ে থাকবে বলেন অতিরিক্ত পিপি অ্যাডভোকেট হাসান মাহবুব সাদী। তিনি বলেন, এ ধরনের রায় উদাহরণযোগ্য।

একই আদালত এর আগে তিন দফায় ৯৫ মামলায় ১৩৩ জন শিশুকে প্রবেশন দিয়ে মামলা থেকে নিষ্কৃতির মাধ্যমে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। একইভাবে এর আগে এই আদালতের বিচারক নারী ও শিশু নির্যাতন দমন মামলায় দুই দফায় সুনামগঞ্জের প্রায় দেড় শতাধিক দম্পতিকে বিচ্ছেদের হাত থেকে রক্ষা করে আপোষে তাদের মামলা সমূহ নিষ্পত্তি করে স্বামী, স্ত্রী ও তাদের সন্তানদের সুখীজীবন ফিরিয়ে দেন।

ভয়েসটিভি/এএস

You may also like