Home ভিডিও সংবাদ শিক্ষার আলো ছড়ানো বাতিঘর!

শিক্ষার আলো ছড়ানো বাতিঘর!

by Newsroom

চাটমোহর রাজা চন্দ্রনাথ ও বাবু শম্ভুনাথ মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। যার সংক্ষিপ্ত রুপ চাটমোহর আর.সি.এন এন্ড বি.এস.এন মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। এটি বৃহত্তর পাবনা জেলার দ্বিতীয় প্রাচীনতম ও ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপিঠ। বৃটিশ শাসনামলের সিপাহী বিদ্রোহের ঠিক চার বছরের মাথায় ১৮৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বিদ্যালয়টি।

কালের সাক্ষী ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যাপীঠ পাবনার চাটমোহরের নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত। প্রতিষ্ঠানটি ৯১ শতাংশ জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত। এছাড়া প্রায় ৩ একর জায়গার উপর রয়েছে খেলার মাঠ।

প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা হয় তৎকালীন নাটোরের মহারাজ রাজা চন্দ্রনাথ ও চাটমোহরের পার্শ্বডাঙ্গার জমিদার বাবু শম্ভুনাথের নামানুসারে। রাজা চন্দ্রনাথ ছিলেন নাটোরের মহারানী, ভবানীর উত্তরসূরি। শিক্ষা ও সমাজ সেবায় যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করতেন তিনি। অন্যদিকে, বাবু শম্ভুনাথ ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী ও দানশীল ব্যক্তি।

বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাকাল থেকে, বহুবার দাঙ্গা ও অগ্নিসংযোগে বিদ্যালয়ের মূল্যবান রেকর্ডপত্র নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বেশ কিছু নথি আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়। ফলে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির, তথ্যসমৃদ্ধ কোনো ইতিহাস সংরক্ষিত নেই। পাওয়া যায়নি প্রতিষ্ঠাতাদের কোন ছবি। জানা যায়নি প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের নাম। কতজন শিক্ষার্থী নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির পথ চলা শুরু হয় তা রয়েছে অজানা।

স্থানীয় মানুষের নানা প্রচেষ্টায় ১৯১১ সালে কিছু তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়। তখনকার তথ্যমতে, বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক ছিলেন বাবু ক্ষিতিশ চন্দ্র। সে সময়ে স্বর্গীয় পূর্ণচন্দ্র লাহিড়ী, শশধর কুন্ডু, অবনীনাথ বিশ্বাসসহ মোট ৫ জন হিন্দু ছাত্র এন্ট্রান্স পাস করেন।

১৯১২ সালে মরহুম হারুন উর রশিদ প্রথম মুসলিম ছাত্র হিসেবে অত্র বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন। পরবর্তীতে দীর্ঘ বিরতির পর ১৯১৭ সালে মরহুম মমিন উদ্দিন মিয়া ও সীতাবুদ্দিন সরকার যৌথভাবে দ্বিতীয় মুসলিম ছাত্র হিসেবে উত্তীর্ণের তালিকায় নাম লেখান।

প্রতিষ্ঠানটির নামকরণের ইতিহাস থেকে জানা গেছে, বৃটিশ শাসনামলের সিপাহী বিদ্রোহের পরে মানুষের মাঝে ধারণা আসে, ইংরেজদের সঙ্গে লড়তে হলে অবশ্যই ইংরেজি ভাষায় শিক্ষিত হতে হবে। সেই ধারণা থেকে চাটমোহরে তদানীন্তন গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এলাকায় একটি ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইচ্ছে পোষণ করেন।

তৎকালীন সময় এ উপলক্ষে একটি সভার আয়োজন করা হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন পাবনা জেলার ইংরেজ কালেক্টর। মানুষের কাছে তিনি প্রশ্ন করে বলেন, বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার কিভাবে মেটানো হবে?? এমন সময় হাতিতে চড়ে বাবু শম্ভুনাথ ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন।  বর্তমান বিদ্যালয় মাঠে জনসমাগম দেখে বাবু শম্ভুনাথ সভাস্থলে যান। পরে সব কথা শুনে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সব ব্যয় বহনের ঘোষণা দেন। তার নামেই শুরু হয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ।

বিষয়টি জানতে পারেন নাটোরের মহারাজা চন্দ্রনাথ। তিনি অত্র অঞ্চলের শিক্ষা বিস্তারের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাই রাজার আত্মসম্মানে আঘাত লাগলে, তিনিও রাজা চন্দ্রনাথ নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা শুরু করেন। মাত্র এক কিলোমিটারের মধ্যে রাজা ও জমিদারের পৃথক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়ায় শুরু হয় তীব্র প্রতিযোগিতা। দুই বিদ্যালয়ের  শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে প্রতিনিয়তই লেগে থাকতো  দ্বন্দ্ব আর সংঘর্ষ।

কিন্তু বাবু শম্ভুনাথ হাল না ছেড়ে, নিজ বৈঠকখানায় শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যান। পরে তিনি বিদ্যালয় স্থানে ইউ আকৃতির একটি পাকা ভবন নির্মাণ শুরু করেন। তৎকালীন সময়ে রাজার অনুমতি ছাড়া কেউ রাজ্যে পাকা নির্মাণ কাজে ছাদ ঢালাই করতে পারতো না। তখন নাটোরের রাজা ওই কাজ বন্ধে আদালতের নিষেধাজ্ঞা জারী করান। এই খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবু শম্ভুনাথ পাবনা সদরে গিয়ে নিষেধাজ্ঞা ব্যাকেড করে রাতা রাতি ছাদ ঢালাইয়ের কাজ শেষ করেন। এতে হেরে যান অর্ধবঙ্গেশ্বর নাটোর রাজ।

১৮৭৫ খ্রীষ্টাব্দে রাজা চন্দ্রনাথ ও ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দে শম্ভুনাথ বাবু মৃত্যুবরণ করেন। রাজা চন্দ্রনাথ ও বাবু শম্ভুনাথের মৃত্যুর পর তাদের উত্তরসূরির দ্বন্দ্ব, কলহ, রেষারেষিতে প্রতিষ্ঠান দুটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরী হয়। ১৯২৯ সালের ১৪ জানুয়ারি তৎকালীন ম্যাজিষ্ট্রেট ইজি ক্রিক ও জলপাইগুড়ির রেঞ্জ ইন্সপেক্টর অব স্কুলস, মিঃ ব্যানার্জি চাটমোহর আসেন।

দুই প্রতিষ্ঠানের উত্তরসূরীসহ স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে, সর্বসম্মতিক্রমে দুটি বিদ্যালয়কে একীভূত করা হয়। পরে বাবু শম্ভুনাথের নির্মাণ করা পাকা ভবনেই, বিদ্যালয়ের কাজ শুরু করার সিন্ধান্ত আসে। কিন্তু বিপত্তি থেকে যায় বিদ্যালয়ের নামকরণ নিয়ে।

বাবু শম্ভুনাথের উত্তরসূরীদের দাবি ছিলো, তাদের বিদ্যালয়ের পাকা ভবন তাই বাবু শম্ভুনাথের নাম প্রথমে থাকবে। অপরদিকে, রাজা চন্দ্রনাথের নামও প্রথমে রাখার দাবি জানায় তাঁর উত্তরসুরীরা। উভয় পক্ষই তাদের দাবিতে অনঢ় থাকেন। তখন বিদ্যালটির নামকরনে আরও জটিলতা তৈরী হয়। এই অবস্থায় ম্যাজিষ্ট্রেট ক্রিক কৌশলের আশ্রয় নেন। তিনি প্রস্তাব দেন, যেহেতু নাটোরের মহারাজা অত্যন্ত সম্মানিত এবং তিনি অর্ধবঙ্গেরশ্বর। তাই তাকে সম্মান দেয়া জরুরী। তখন মহারাজার নাম আগে রাখার প্রস্তাব দিলে সবাই সম্মতি জানায়।

ফলশ্রুতিতে প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা হয় রাজা চন্দ্রনাথ ও বাবু শম্ভুনাথের নামে। সেই থেকে বিদ্যালয়টির নাম চাটমোহর রাজা চন্দ্রনাথ ও বাবু শম্ভুনাথ মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়।

১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে বিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তি উদযাপন করা হয়। এর পর ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে এসে গৌরবময় ১৫২ বছর পূর্তি উদযাপন করা হয়। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে, শিক্ষার আলো ছড়ানো বাতিঘরে পরিণত হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। থেমে নেই শিক্ষাবিস্তারের অগ্রযাত্রা। এতগুলো বছরে এই বিদ্যালয় জন্ম দিয়েছে বহু ক্ষনজন্মা পুরুষকে। যারা দেশ ও বিদেশে সম্মান বয়ে এনেছেন।

ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন- বিচারপতি দিলারুজ্জামান, পাবনা-৩ আসনের সাবেক সাংসদ কেএম আনোয়ারুল ইসলাম, নটর ডেম কলেজের অধ্যক্ষ বেনজামিন কস্তা, বিগ্রেডিয়ার এ কে এম সাইফুল ইসলাম সেলিম, পেট্টোবাংলার জিএম এটিএম শাহ আলম আতা, নাসার প্রকৌশলী শাহাদত হোসেন রানা, আমেরিকা প্রবাসী চিকিৎসক এবিএম শহীদুল্লাহ দুলাল এবং নাট্যকার বৃন্দাবন দাসসহ অনেক গুণীজন এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন।

প্রতিষ্ঠানটি তথ্য-প্রযুক্তিগত দিকে কিছুটা এগিয়ে গেলেও পুরনো আর জরাজীর্ণ অবকাঠামোতে এখনো সীমাবদ্ধ। দীর্ঘ পথচলায় বহুতল ভবন পায়নি প্রতিষ্ঠানটি। একতলা আর দ্বিতল ভবনের মধ্যেই চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। মাধ্যমিকের পাশাপাশি ২০১৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে পাঠদানের অনুমতি দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড রাজশাহী। সেই থেকে প্রতিষ্ঠানটির নাম হয় চাটমোহর রাজা চন্দ্রনাথ ও বাবু শম্ভুনাথ মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ। এরইমধ্যে দুটি ব্যাচও বের হয়ে গেছে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে মানবিক, বিজ্ঞান ও বাণিজ্য শাখা চালু রয়েছে। এছাড়া কারিগরী শাখায় পড়াশোনার সুযোগেও রয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে। ২০১২ খ্রীষ্টাব্দে স্কুলটির কারিগরি শাখায় দেশের মধ্যে ৮ম স্থান অধিকার করে। এটি উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

ঐতিহ্যবাহি এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমিক পর্যায়ে ৩২৫ জন ছাত্রীসহ একহাজারের বেশি শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছেন। প্রতিবছর জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় ১২/১৩ জন বৃত্তিলাভ করছে। এছাড়া ২০০৯ খ্রীষ্টাব্দে জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় রাজশাহী শিক্ষবোর্ডে ২য় স্থান লাভ করে। এসএসসি পরীক্ষায়ও ভালো ফলাফল করে আসছে শিক্ষার্থীরা।

৩০ টি শ্রেণি কক্ষে পরিচালিত হচ্ছে পাঠদান কার্যক্রম। ৩৯ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা আর কর্মচারীর মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকসহ আরও একটি পদ শূন্য রয়েছে। এরইমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ও আইটিসি শিক্ষক নিউজিল্যান্ড ও থাইল্যান্ড থেকে শিক্ষার উপর প্রশিক্ষণ পেয়েছেন।

প্রতিষ্ঠানটিতে জাতীয় পর্যায়ের প্রায় প্রত্যেকটি খেলার ব্যবস্থা রয়েছে। ২০০৭, ২০০৮ ও ২০০৯ খ্রীষ্টাব্দে জাতীয় স্কুল ও মাদরাসার শীতকালীন ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় স্কুলটি জেলা চ্যাম্পিয়ন এবং ২০০৭ ও ২০১২ খ্রীষ্টাব্দে বিভাগীয় পর্যায় রানার-আপ হওয়ার গৌরব অর্জন করে। এছাড়া জাতীয় পর্যায়ে ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন ও রানার-আপের পুরস্কার রয়েছে। রয়েছে বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে জাতীয় পর্যায়ে রানার-আপ হওয়ার পুরস্কারও।

খেলাধুলার পাশাপাশি নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও জাতীয় সকল কর্মসূচী পালন করা হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে স্কাউটিংয়ের ব্যবস্থা। বিদ্যালয়টির বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের হাতে কলমে বাস্তব সম্মত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে রয়েছে একটি আধুনিক বিজ্ঞানাগার। এছাড়া সব ক্লাসের শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি শিক্ষায় জ্ঞান বাড়ানোর জন্য রয়েছে একটি কম্পিউটার ল্যাব।

শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের জন্য রয়েছে একটি পাঠাগার। এখান থেকে বই সংগ্রহ করে অথবা টিফিনের ফাকে বসে বই পড়ার সুযোগ পায় শিক্ষার্থীরা। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটিতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ কর্নার, শিক্ষক মিলনায়তন, অফিস কক্ষ, শহীদ মিনার ও সাইকেল গ্যারেজ।

ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে বেতন আদায় ছাড়া বাড়তি আয়ের পথ হিসেবে প্রতিষ্ঠানের সম্মুখে ৩৮ টি দোকান ঘরের একটি মার্কেট রয়েছে। আদায়কৃত দোকান ভাড়া বিদ্যালয়ের উন্নয়ন খাতে যুক্ত হয়। ইতিহাস, ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এই প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘপথ পরিক্রমায় ২০১৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জাতীয়করণ করা হয়। তখন প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে সরকারি যুক্ত হয়ে, নাম হয় চাটমোহর সরকারি রাজা চন্দ্রনাথ ও বাবু শম্ভুনাথ মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ।

ভয়েস টিভি/তৌহিদ

 

You may also like