১৯২৮ সালের ৬ জুন, দেওয়ান রঘুনাথ দত্ত ও কুলবন্তী দেবী দত্তের কোলজুড়ে আসে বলরাজ দত্ত নামে এক পুত্রসন্তান। পরে ফিল্মি দুনিয়ায় যিনি সুনীল দত্ত নামে পরিচিতি পান। সুনীল দত্ত ছিলেন একজন রেডিও জকি, অভিনেতা ও রাজনীতিবিদ। ‘মাদার ইন্ডিয়া’ সিনেমায় সুনীল দত্তের মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বয়সে এক বছরের বড় বলিউডের ইতিহাসে অন্যতম সেরা অভিনেত্রী ২৮ বছরের নার্গিস। একদিন শুটিং সেটে আগুন লেগে গেলে সুনীল দত্ত জীবন বাজি রেখে উদ্ধার করেন নার্গিসকে। সেই দিন থেকেই দুজন দুজনের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেন। দু’জনের মনে ফুটেছিল ভালোবাসার লাল গোলাপ। ১৯৫৯ সালের ২৯ জুলাই এই তারকা দম্পতির ঘর আলো করে আসেন সঞ্জয় বলরাজ দত্ত।
বলিউডে সঞ্জু বা সঞ্জুবাবা নামে পরিচিত সঞ্জয়ের জীবন ঠিক যেন সিনেমা। কড়া শাসনের মধ্যে থেকেও এই অভিনেতা ছিলেন বাবার বিগড়ে যাওয়া সন্তান। ৯ বছর বয়সে সিগারেটে টান। এরপর একসময় বুঁদ হয়েছিলেন নেশায়। প্রথম সিনেমা ‘রকি’র নায়িকা টিনা মুনিমের প্রেমে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন সঞ্জয় দত্ত। সঞ্জয়ের পরিবার এই সম্পর্ক মেনে না নেওয়ায় টিনাকে হারানোর বেদনায় ভেঙ্গে পড়েন। অন্যদিকে সিনেমা মুক্তির কিছুদিন আগে মারা যান তার মা নার্গিস মারা যান। অনেকে মনে করেন প্রেমিকা হারানোর বেদনা এবং মা নার্গিসের মৃত্যুর শোকেই সঞ্জয় মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। টিনা মুনিম পরে ভারতের বিখ্যাত ধনকুবের অনিল অম্বানিকে বিয়ে করেন।
১৯৮২ সালে বছরের সবচেয়ে ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র ‘বিধাতা’ ১৯৮৩ সালে সুপারহিট ম্যাঁ আওয়ারা হুঁ চলচ্চিত্র উপহার দেন। তিন বছর পর ১৯৮৫ সালে ‘জান কি বাজি’ ছবিতে কাজ করেন। ব্যক্তিগত সমস্যা ও মাদকাসক্তি নিরাময়ের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পূর্বে সঞ্জয় অভিনীত কয়েকটি চলচ্চিত্র ফ্লপ করলে পুনরায় চলচ্চিত্রে না ফিরে আসার কথা জানান। কিন্তু সে বছরই অনেকটা সুস্থ হয়ে আবার বলিউডে প্রত্যাবর্তন করেন সঞ্জয়। এরপর ৩৯ বছরের ক্যারিয়ারে একেএকে উপহার দেন ব্যবসাসফল বহু সিনেমা- গ্যাংস্টার, গুন্ডা ও পুলিশ অফিসার ছাড়াও নানান চরিত্রে ১৮৭-টির বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন সঞ্জয়।
১৯৮১ সালে ‘রকি’ ছবিতে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে পা রাখেন সঞ্জয়। পিতা সুনীল দত্ত পরিচালিত চলচ্চিত্রটি বক্স অফিস হিট করলে এবং নিজের অভিনীত প্রথম ছবিতেই সাফল্যের স্বাদ পেয়ে চলচ্চিত্রে থিতু হন সঞ্জয়। এর আগে ১৯৭২ সালে শিশুশিল্পী হিসেবে ‘রেশমা অউর শেরা’তে শিশু কাওয়ালি গায়ক হিসেবে অভিনয় করেছিলেন।
বলিউডের এই সুপারস্টারের অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর মধ্যে- খলনায়ক, বাস্তব, মুন্না ভাই এম.বি.বি.এস, পিকে, জিতে হ্যাঁ শান সে, মার্দো ওয়ালি বাত, ইলাকা, হাম ভি ইনসান হ্যায়, কানুন আপনা আপনা ইত্যাদি। দুটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার, দুটি আইফা পুরস্কার, দুটি বলিউড মুভি পুরস্কার, দুটি স্ক্রিন পুরস্কার, তিনটি স্টারডাস্ট পুরস্কার, একটি করে গ্লোবাল ইন্ডিয়ান ফিল্ম পুরস্কার ও বঙ্গ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার অর্জন করেন।
সঞ্জয় দত্ত ১৯৮৭ সালে প্রথম বিয়ে করেছিলেন রিচা শর্মাকে, এরপর ১৯৯৮ সালে রিয়া পিল্লাইয়ের সঙ্গে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। ২০০৮ সালে তাদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ হলে একই বছরে মান্যতার সঙ্গে সাতপাকে বাধা পড়েন। ১৯৮৮ সালে প্রথম স্ত্রী রিচা শর্মার গর্ভে সঞ্জয় কন্যা ত্রিশলা জন্মগ্রহণ করেন। এরপর ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর তৃতীয় স্ত্রী দিলনেওয়াজ শেখ ওরফে মান্যতা দত্তের গর্ভে শাহরান দত্ত ও ইকরা দত্ত নামে সঞ্জয়ের জমজ ছেলেমেয়ের জন্ম হয়।
বলিউডের বিতর্কিত পুরুষের তালিকায় সঞ্জয় দত্তের নাম সকলের শীর্ষে। একের পর এক হিট ছবিতে অভিনয় করলেও তার জীবন জুড়ে রয়েছে নানান ট্র্যাজেডি। ৬২-তে পা দেওয়া বলিউডের মুন্না ভাইয়ের বান্ধবীর সংখ্যা হাতে গুনে শেষ করা যাবে না। একাধিক নারীসঙ্গ, শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত সঞ্জয় কত মেয়ের যে শয্যাসঙ্গী হয়েছে তাও নাকি গুনে শেষ করা যাবে না। শোনা যায় সাড়ে ৩ শতাধিক প্রেমিকা ছিল সঞ্জয়ের। এরমধ্যে ৩০৮ জন নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছেন বলিউডের এই ব্যাড বয়।
১৯৯৩ সালে বেআইনিভাবে অস্ত্র রাখার দায়ে গ্রেপ্তার হন সঞ্জয় দত্ত। ১৮ মাস জেল খাটার পর জামিনে মুক্তি পান তিনি। এরপর আবারও ২০১৩ সালে হাইকোর্টের রায়ে ৫ বছরের সাজা খেটে ২০১৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সাজা ভোগকালীন ভাল ব্যবহার ও আচরণের জন্য তিনি জেল থেকে মুক্তি পান।
সঞ্জয় দত্তের জীবন কাহিনী নিয়ে তৈরি হয় ‘সঞ্জু’ চলচ্চিত্রটি। ‘সঞ্জু’ ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যবসাসফল ছবিগুলোর মধ্যে একটি। ১৫০ কোটি খরচ করে বানানো এই ছবি বক্স অফিস থেকে তুলে এনেছে ৮৮০ কোটি টাকা। আর যত পুরস্কার ঝুলিতে ভরেছেন, সেই তালিকার কেবল শুরু আছে, শেষ নেই। সঞ্জয় দত্তের জীবন কাহিনী নিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থের নাম তাই, ‘কুছ তো লোগ কাহেঙ্গে’।