স্থলচর প্রাণীর মধ্যে পৃথিবীতে বৃহত্তম ও অধিক শক্তির অধিকারী হাতি, কিন্তু কার্যত তারা বিশ্বের কোথাও ভালো নেই। বাংলাদেশের মতো কম বনভূমি আর জনবহুল দেশে হাতির অবস্থা এখন বিশেষ রকম ঝুঁকির মুখে।
আবাসস্থল ধ্বংস ও মানুষের সঙ্গে সংঘাত বেড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে সম্প্রতি একের পর এক হাতির মৃত্যু ঘটছে। এতে করে দেশে প্রাণীটির অস্তিত্ব নিয়েই বিশেষজ্ঞমহল ও পরিবেশ সচেতন মানুষ উদ্বিগ্ন। দেশে গত ২৫ বছরে হত্যার শিকার হয়েছে ১৫০টির বেশি হাতি।
বন্য প্রাণী সংরক্ষণ বিষয়ক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) হিসাবে, ভারত থেকে মাঝে মাঝে আসা হাতিসহ দেশে হাতির সংখ্যা মোটাদাগে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০-এর মতো। সংস্থাটির সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী, শেরপুরের বনাঞ্চলে বিচরণকারী হাতির সংখ্যা মাত্র ১২০ থেকে ১২৫টি। ২০০৪ সালের জরিপ অনুযায়ী, চট্টগ্রাম অঞ্চলে হাতির সংখ্যা ছিল ২২৭টি।
সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, দেশে নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মাত্র পাঁচ দিনেই হত্যা ও অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার হয়েছে পাঁচটি হাতি। সর্বশেষ গত শনি ও রবিবার আরো দুটি হাতির মৃত্যু ঘটেছে। বনের কাছঘেঁষা জনপদে হাতির হামলায় বহু মানুষেরও মৃত্যু ঘটেছে।
হত্যাসহ অস্বাভাবিক মৃত্যু অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশের বনাঞ্চল থেকে এশীয় প্রজাতির হাতি বিলীন হওয়ারই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ প্রজাতিটি ১৯৮৬ সাল থেকেই (আইইউসিএন)-এর লাল তালিকায় রয়েছে।
যেভাবে মরছে হাতি : দেশে বন্য হাতির বিচরণক্ষেত্র দুটি- শেরপুর-জামালপুর-ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী গারো পাহাড় অঞ্চল ও বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল। প্রথম অঞ্চলে মূলত ভারত থেকে আসা ‘পরিযায়ী’ হাতির বিচরণ। সেখানকার হাতিগুলো ধান বা কাঁঠালের মতো ফলের মৌসুমে খাদ্যের প্রয়োজনে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে চলে আসে।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে গত ছয় বছরে হত্যার শিকার অন্তত ১৫টি হাতির মধ্যে ১১টিই মারা গেছে বৈদ্যুতিক শকে। ছয়টির মৃত্যু হয়েছে গুলিতে। অন্যদিকে শেরপুর অঞ্চলে ২০১৪ সাল থেকে সাত বছরে যে ১৮টি হাতির মৃত্যু ঘটেছে তার মধ্যে আটটিরই মৃত্যু হয়েছে বিদ্যুতায়িত হয়ে। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে তিনটি। হাতির মৃত্যুর অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে অসুস্থতা, বয়সজনিত কারণ, খাদ্যে বিষক্রিয়া ও পিটিয়ে মৃত্যু। ভারতের বনসংলগ্ন জনপদে হামলায় আহত হয়ে এপারে এসে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে থাকে।
কমছে বিচরণক্ষেত্র, চলার পথ : বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ, পরিবেশকর্মী ও বন বিভাগের কর্মকর্তারাসহ সবাই বলছেন, হাতির অবাধে বিচরণের জায়গাগুলো দ্রুত কমে আসছে। বন এলাকায় মানুষের বসতি বৃদ্ধি ও বিভিন্ন প্রকল্পের কারণে হাতির চলাচলের অনেক করিডর বন্ধ হয়ে গেছে। হাতির চলাচলের পথে বাধা এলে ঘটে মানুষের সঙ্গে সংঘাত। খাবারের ভাণ্ডারে টান পড়ার কারণেও জনপদে হানা দিচ্ছে তারা। বাধা পেলে ক্ষিপ্ত হয়ে চড়াও হচ্ছে মানুষের ওপর। আইইউসিএনের ২০১৬ সালের এক সমীক্ষা মতে, বৃহত্তর চট্টগ্রামে হাতির চলাচলের ১১টি করিডর ছিল। এর বেশির ভাগ কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে।
বনে অবৈধ দখল ও চাষাবাদ : আইইউসিএনের ২০১৬ সালের সমীক্ষায় হাতির জন্য ঝুঁকি হিসেবে বনভূমি দখল ছাড়াও বন ঘেঁষে ধানসহ ফসল চাষ বৃদ্ধি পাওয়াকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। পাহাড় ও বনে অবৈধ বসতি স্থাপন করার কারণে বন্য হাতির আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে। শেরপুর সহকারী বনরক্ষকের কার্যালয়ের হিসাব মতে, জেলার প্রায় ২০ হাজার একর বনের মধ্যে অবৈধ দখলে রয়েছে দুই হাজার ৪০০ একর। প্রসঙ্গত, বেশির ভাগ হাতির মৃত্যু ঘটেছে ফসলের মৌসুমে, অর্থাৎ জুলাই থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যে।
বাড়ছে হাতির প্রতি নিষ্ঠুরতা : হাতি জনপদে নেমে এলে আগে পটকা ফুটিয়ে, মশাল জ্বেলে বা টিন পিটিয়ে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হতো, কিন্তু কয়েক বছর ধরে বৈদ্যুতিক ফাঁদের প্রবণতা বেড়েছে। না বুঝে বিদ্যুতায়িত বেড়ার সংস্পর্শে এসে মারা পড়ছে প্রাণীটি। লোহার বল্লম গরম করে হাতির শরীরে ছুড়ে মারা হচ্ছে। চোরাশিকারিরা দাঁতসহ দেহাংশের লোভেও প্রাণীটিকে হত্যা করছে। শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার খ্রিস্টানপাড়া গ্রামের বাসিন্দা শিক্ষক বিহার জাম্বিল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগেও আবাদ-ফসল হতো। তখন তো এত হাতি মারা যায় নাই। এখন যেভাবে জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করে ফাঁদ পাতে, তখন সেগুলো ছিল না।’
আইন-মামলার ফল শূন্য : হাতি হত্যার ঘটনায় চট্টগ্রাম অঞ্চলে বন বিভাগের পক্ষ থেকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রায় ৪০টি মামলা করা হয়েছে। তবে হত্যার ঘটনার ওপর স্পষ্টতই মামলা বিশেষ কোনো প্রভাব ফেলছে না। অভিযোগ রয়েছে, হাতি হত্যায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে পুলিশ খুব একটা উৎসাহ দেখায় না। আবার সুষ্ঠু তদন্ত্ত না হওয়ায় আদালতে গিয়েও অপরাধীরা সুবিধা পায়। বন বিভাগের কর্মকর্তা, পরিবেশকর্মী ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বন্য হাতি হত্যার ঘটনায় সাজার কোনো রেকর্ড নেই।
চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম চৌধুরী গত সপ্তাহে কালের কণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘হাতি হত্যার বেশির ভাগ মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। শাস্তি না হওয়ার কারণে অপরাধীরা লাগামছাড়া হয়েছে।’ উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, হাতি হত্যার এই ধারা অব্যাহত থাকলে দেশের বনাঞ্চল হাতিশূন্য হতে বেশি সময় লাগবে না।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে ঘাটতি : সরকার হাতি সংরক্ষণের লক্ষ্যে ২০১৮ সালে ‘বাংলাদেশ হাতি সংরক্ষণ অ্যাকশন প্ল্যান (বিইসিএপি)’ প্রণয়ন করে। এই পরিকল্পনায় মানুষ ও হাতির মধ্যে সংঘাত ও চোরাশিকার বন্ধ করা ও হাতির আবাসস্থল সংরক্ষণ বিষয়ে গবেষণাসহ ছয়টি লক্ষ্য ছিল। গত তিন বছরে এটি বাস্তবায়নের দৃশ্যমান নজির দেখা যায়নি। শেরপুরে বন্য হাতির অভয়াশ্রম গড়ে তোলার জন্য ২০১৪ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। এ ব্যাপারেও অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়।
এ ছাড়া উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের সময় বন বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় হচ্ছে না বলে অভিমত দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। তিনি বলেন, বন কেটে রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল, রাষ্ট্রীয় স্থাপনা, রেললাইন নির্মাণ এবং সাতকানিয়ার বায়তুল ইজ্জত এলাকায় সরকারি স্থাপনা গড়ে তোলার কারণে হাতির চলাচলের পথ কমে গেছে।
হাতি সুুরক্ষায় চলমান উদ্যোগ : চট্টগ্রাম-কক্সবাজারে বন বিভাগের ২৭টি ‘এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম’ (ইআরটি) কাজ করছে। স্থানীয় গ্রামবাসীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে গঠন করা এ টিমের কাজ হল লোকালয়ে চলে আসা হাতিকে বনে ফিরিয়ে দেওয়া।
বন কর্মকর্তারা আরো জানিয়েছেন, হাতির খাবারের সংস্থানের জন্য বাঁশ, কলা, কাশফুলের বাগান, আমলকী, হরীতকী, বহেড়া ও চাপালিজাতীয় গাছ লাগানো হচ্ছে। পাশাপাশি খাবারের সংস্থানের আরো স্থায়ী রূপ দেওয়ার বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে। হাতিকে বনে রাখার জন্য ‘সুফল’ প্রকল্পের আওতায় ওষধি, ফলমূল ও কাঠগাছ রোপণ করা হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, এতে বনে গাছের ঘনত্ব বাড়বে।
বিশেষজ্ঞের পর্যবেক্ষণ : এশিয়ান এলিফ্যান্ট স্পেশালিস্ট গ্রুপের সদস্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজ বলেন, ‘বন্য হাতিরা খুবই বিপদাপন্ন। এ নিয়ে আমরা যতই কথা বলি, দৃশ্যমান, কার্যকর উদ্যোগ না থাকলে শুধু হা-হুতাশ করে কিছু হবে না।’
তিনি এ বিষয়ে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থানয় স্থায়ী কমিটির সক্রিয় ভূমিকার প্রত্যাশা করেন। অতীতে পরিবেশ ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ বিষয়ক উদ্যোগে এ কমিটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখা গেছে মন্তব্য করে।
তিনি বলেন, সংসদীয় কমিটি যদি সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের যুক্ত করে উদ্যোগ নেয় তাহলে তা কার্যকর হতে পারে। পাহাড়ে চাষবাসের জন্য বন বিভাগের জমি ইজারা দেওয়া বন্ধ করাসহ প্রশাসনের সক্রিয়তার ওপরও জোর দিতে হবে।
ভয়েসটিভি/এমএম