Home জাতীয় স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের পট পরিক্রমা

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের পট পরিক্রমা

by Amir Shohel

বিজয়ের পঞ্চাশ দশকে এসে বাংলাদেশ এক পরিণত যুবক। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় বিশ্বের দরবারে এক রোল মডেল। যার সূত্রপাত হয়েছিলো ১৯৭১ এ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এক অগ্নিঝরা কণ্ঠে। সে স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে বাংলাদেশ আজ বিশ্বদরবারে প্রশংসিত।

তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে শামিল হতে এগিয়ে চলেছে। যোগাযোগ ও প্রযুক্তিসহ অর্থনৈতিক নানা মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন পিছিয়ে নেই কোনো ক্ষেত্রেই। এতো চড়াই উৎরাইয়ের পেছনে ছিলো অনেক ইতিহাস চ্যালেঞ্জ আর দুঃসাহসী নেতৃত্বের নানা অখ্যান।

অর্থনৈতিক উন্নতি, সামাজিক সূচকের অগ্রগতিতে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারের দেশটি ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রে। অনেক সূচকে দক্ষিণ এশিয়াকেও ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। ফলে আজকের বাংলাদেশ সারাবিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।

পদ্মায় মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু, মহাকাশে সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। উন্নয়নের রোড প্ল্যান ধরে নির্মিত হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা সমুদ্রবন্দর, বঙ্গবন্ধু টানেল, এলএনজি টার্মিনাল।

নাগরিক যোগাযোগে বিপ্লব যোগ করেছে মেট্রোরেল প্রকল্প। ঢাকা-চট্টগ্রামের যোগাযোগ চিত্র বদলে দিয়েছে ফ্লাইওভার। অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় গতি যোগ করতে দেশে গড়ে উঠছে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল।

ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ, বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তথ্যপ্রযুক্তির সুফল ভোগ করছে দেশের জনগণ। ইউনিয়ন পর্যায়ে সহজলভ্য হয়েছে ইন্টারনেট ও প্রযুক্তি সেবা।

স্বাধীনতার ৪৯ বছরে বেড়েছে মাথাপিছু আয় বেড়েছে প্রায় ১৮ গুণ, বৈদেশিক ডলারের রিজার্ভ। কমেছে শিশু মৃত্যুর হার। বেড়েছে গড় আয়ু ও মানবসম্পদের সূচকও অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে।

বেড়েছে অর্থনীতির আকার, সমৃদ্ধশালী হচ্ছে অর্থনীতি। আকারে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। উন্নয়ন অগ্রগতির ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩৩ সাল নাগাদ বিশ্বের শীর্ষ ২৪তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশের তালিকায় নাম লেখাবে বাংলাদেশ।

শোষন-বঞ্চনার নিষ্পেষিত বাঙালির স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্খা শুরু হয়েছিলো সেই ১৯৬৬ সাল থেকে। সামরিক জান্তা আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলো পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৬ দফা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপট এবং একটি স্বাধীন দেশ বিনির্মানের ইতিহাস। যার কেন্দ্রবিন্দুতে বঙ্গবন্ধুর অসামান্য নেতৃত্ব আর বাঙালি জাতির আত্মত্যাগের নানা গল্প।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। পূর্ব বাংলা হয় পাকিস্তানের অংশ-পূর্ব পাকিস্তান। পূর্ব থেকে জনগণ আশা করেছিলেন, তাঁদের আশা-আকাঙ্খা পূরণ হবে। তাঁদের প্রত্যাশিত স্বাধীনতা নতুন রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হবে। উন্নত জীবনের অধিকারী হবেন।

কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ অনুভব করেন, তাদের প্রত্যাশা পূর্ণ হওয়ার নয়। পাকিস্তানের শাসকরা পূর্ব পরিকল্পিত ঐক্যবদ্ধ একক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র করেছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অংশগ্রহণের ক্ষেত্র সংকুচিত করা হচ্ছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁরা বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। এমন কি পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এভাবেই র্পূব পাকিস্তান স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি তৈরি হয়। ১৯৫২ সালে নিজস্ব ভাষার অধিকার রক্ষার জন্য জীবন দিতে হয় পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-জনতার। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা দখল করে। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙ্গালির স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যো ছয় দফা দাবি পেশ করেন।

ছয় দফা ম্যান্ডেট নিয়ে পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে তার উত্তরণ ঘটে।

জনগণ প্রত্যাশা করেছিল নির্বাচিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে পূর্ব পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের বঞ্চনার ইতিহাসের গতি পাল্টাবেন। কিন্তু তখন ‘বাঙালির শাসন মেনে নেয়া যায় না’ এই নীতিতে পাকিস্তানি সামরিক শাসকগণ নির্বাচিত এই জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে।

জাতীয় সংসদের নির্ধারিত অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ দেশব্যাপী অসহযোগের আহবান জানান। সর্বস্তরের জনগণ একবাক্যে বঙ্গবন্ধুর এই আহবানে সাড়া দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে অচল করে তোলে। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা প্রদর্শিত হয়।

৩ মার্চ রমনা রেসকোর্স বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ এর পক্ষ থেকে ‘স্বাধীনতার ইসতেহার’ পাঠ করা হয়। এই ইসতেহারে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

পাকিস্তান সামরিক বাহিনী পরিচালিত সরকার জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে কোনো সমাধান না দেয়ায়, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে বাঙালি জাতিকে এক দিকনির্দেশনার ভাষণে সবপ্রকার পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হতে আহবান জানান।

বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ পৃথিবীতে উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দের ভাষণগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হিসেবে বিবেচিত। ৭ই মার্চের এই ভাষণে বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশ কোন দলীয় নেতার নির্দেশ ছিল না। ছিল একজন জাতীয় নেতার নির্দেশ। এই নির্দেশ দেশের সর্বস্তরের ছাত্র, জনতা ও বুদ্ধিজীবীদের সাথে বাঙালি সামরিক, বেসামরিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী সকলকেই সচেতন করে তোলে।

২ মার্চ ৭১ থেকে পূর্ব বাংলার সমস্ত প্রশাসনিক কাজকর্ম চলতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের বড় শহরগুলোতে গণহত্যা শুরু করে। তাদের পূর্বপরিকল্পিত এই গণহত্যাটি ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিচিত। ঢাকার পিলখানা, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের ই বি আর সিসহ সারাদেশের সামরিক আধাসামরিক সৈন্যদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ধারণা করা হয়, সেই রাতে একমাত্র ঢাকা ও তার আশে পাশের এলাকাতে প্রায় এক লক্ষ নিরীহ নর-নারীর জীবনাবসান ঘটে।

এরপরই পাকিস্তানি সশস্ত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য বাংলার জনগণকে আহবান জানানো হয় যুদ্ধের। ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু ঘোষণাকে অবলম্বন করে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা এম. এ হান্নান স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।

বঙ্গবন্ধুর সেই ঘোষণার পরই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তি পেতে দেশের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি শাসক ও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে। সেই সংগ্রামে জীবন দিয়েছেন ৩০ লাখ শহীদ, সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন দুই লাখ মা-বোন। বহু ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় লাল-সবুজের এ বাংলাদেশ।

সেদিনের সংগ্রাম শুধু পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার নয়, ছিল অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামেরও। কারণ ওই সময়ে অর্থনৈতিক শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্য ছিল চরমে। ক্ষুধা, অপুষ্টি, স্বাস্থ্যহীনতাসহ নানা কারণে আয়ুষ্কালও ছিলো অনেক কম। শিক্ষার হার ছিলো নিম্নপর্যায়ে। কর্মসংস্থানও ছিল না পর্যাপ্ত।

এমন সময় শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। টানা ৬ মাসে কয়েক লাখ মানুষ শহীদ হয়। অক্টোবর মাসের মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে সমস্ত সীমান্ত এলাকা ছেড়ে দিয়ে সেনানিবাস অথবা বড় বড় শহর ভিত্তিক অবস্থান নিতে বাধ্য হয়। এই সময়ের মধ্যে মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশের প্রায় ৮০ ভাগ এলাকা মুক্ত করেছিল।

নভেম্বর এর প্রথম দিকে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত হয় সম্মিলিত বাহিনী। ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান অতর্কিতভাবে ভারত আক্রমণ করলে যুদ্ধের মোড় পরিবর্তিত হয়। ৬ ডিসেম্বর ভারত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে মুক্তিবাহিনীর মনোবল বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বহু বুদ্ধিজীবিদের পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে।

১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ৯৩ হাজার সৈন্য বিনা শর্তে সম্মিলিত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এই আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন পূর্বাঞ্চলের সম্মিলিত বাহিনী প্রধান লেঃ জেনারেল জগজিত সিং অরোরা ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক লেঃ জেঃ একে নিয়াজী।

এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন মুক্তিবাহিনীর উপ-সেনা প্রধান ও বিমান বাহিনী প্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। এই অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন এস ফোর্স অধিনায়ক লেঃ কর্নেল কে এম সফিউল্লাহ, ২নং সেক্টরের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর এ টি এম হায়দার এবং টাঙ্গাইল মুক্তি বাহিনীর অধিনায়ক জনাব কাদের সিদ্দিকী। এরই মধ্যে বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়। আর প্রতি বছর এই দিনটি ”বিজয় দিবস” হিসেবে উদযাপন করা হয়।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে চুড়ান্ত বিজয়ের পর বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে ছিলো এক খাঁদের কিনারায়। নয় মাসের যুদ্ধে দেশের আইন-শৃংখলা, প্রশাসন, অর্থনীতি, অবকাঠামো সবকিছুই ভেঙে পড়েছে। দেশের সর্বত্র ছিলো এক অরাজক অবস্থা। জাতীয় অর্থনীতিতে দেশের মোট উৎপাদনের শতকরা পঞ্চান্ন ভাগ পণ্য উৎপাদিত হতো কৃষি খাত থেকে। যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের প্রাণ হিসাবে পরিচিত সেই কৃষিখাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমন দশায় যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ একসময় ঘুরে দাঁড়াবে ভাবতে পারেনি অনেকেই। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও অদম্য বাঙালির ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের ফলে উন্নয়নের বিস্ময় এখন বাংলাদেশ।

যুদ্ধের পরে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের চালানো জরিপ অনুসারে, যুদ্ধকালীন সময়ে চাষাবাদের কাজে ব্যবহৃত পশু, চাষের উপকরণ, বীজ ইত্যাদি ধ্বংস হয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনী মাইলের পর মাইল উর্বর ভূমিতে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। এর ফলে প্রায় ৪.৩ বিলিয়ন টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়েছিলো, যা মোট জাতীয় উৎপাদনের ত্রিশ শতাংশ।

বিশেষ করে পাট এবং পাটজাত দ্রব্য ছিলো বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি দ্রব্য। রপ্তানি আয়ের আশি শতাংশ অর্থাৎ ৩০০ থেকে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার আসতো পাট থেকেই। পাটের গুদাম ধ্বংস, পাটকলের ক্ষতিসাধন, অকেজো বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে স্বাধীন বাংলাদেশের কাছে পাটশিল্পকে আবার আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা পরিণত হয় প্রধান চ্যালেঞ্জে।

পাটের পাশাপাশি বাংলাদেশের আরেক গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী পণ্য চায়ের উৎপাদনও ক্ষতিগ্রস্ত হয় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে। ১৯৭০-৭২ সালে চায়ের উৎপাদন এক তৃতীয়াংশ কমে দাঁড়ায় ছাব্বিশ মিলিয়ন পাউন্ডে। রপ্তানি বাজার সংকুচিত হয়ে আসে। রাস্তাঘাট, অবকাঠামোর ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়ে থাকা বন্দর ব্যাপকভাবে আমদানি-রপ্তানি কাজকে ব্যাহত করে।

স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি বড় অংশ দখল করে আছে গেরিলা যুদ্ধ। এই গেরিলা যুদ্ধের কারণে নদীমাতৃক দেশের ভেতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় তিনশো সেতু ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় ছিলো। স্বাধীনতার পরে দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে মালামাল পরিবহণ করার কাজটিও দুঃসাধ্য হয়ে যায়।

এই বিপুল পরিমাণ ক্ষতি মাথায় নিয়ে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিলো। মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ২৪৭টি রেল ব্রীজের ১৯৪টিকে মেরামত করে ব্যবহার উপযোগী করা হয় ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে। রেল যোগাযোগ সীমিত আকারে শুরু হয় তবে বড় ব্রীজগুলো মেরামত করতে আরো ছয় মাসের মতো সময় লাগে।

তাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রধান লক্ষ্য ছিলো খাদ্যসামগ্রীর অভাব দূর করা, যেকোনো মূল্যে দুর্ভিক্ষ ঠেকানো। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে খাদ্যশস্যের ঘাটতি দাঁড়ায় চল্লিশ লক্ষ টন। তাই সদ্য স্বাধীন এই দেশকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজন ছিল বিদেশী বিভিন্ন দেশের সাহায্যের। সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশের দরকার ছিল খুব সুচারু একটি পররাষ্ট্র নীতি।

তাই স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ জোট নিরপেক্ষতা, সবার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ঘোষণা দেয় এবং সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে তার অবস্থান জানায়। বিশ্বের সকল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহ প্রকাশ করায় ১৯৭২ সালের ১ জুনের মধ্যে ৭৫টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। বাহাত্তরের শেষ নাগাদ সেই সংখ্যা ৯৪টিতে দাঁড়ায়।

স্বাধীনতা লাভের একদম শুরু থেকেই প্রভাবশালী সোভিয়েত ইউনিয়ন আর প্রতিবেশী ভারত এই দুইটি দেশ বরাবরই বাংলাদেশকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কূটনৈতিক মহলে সেই সহায়তার অনেক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আছে তবে শিশু বাংলাদেশের বেঁচে থাকার জন্য এই পদক্ষেপগুলো অনেক জরুরী ছিল। ১৯৭২ সালের ৩ মার্চ গৃহীত হয় বাংলাদেশ আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি।

সোভিয়েত বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া চট্টগ্রাম বন্দরকে সারিয়ে তোলা হয়, ভারতীয় নৌবাহিনী ভাসমান মাইন সরানো এবং অবরুদ্ধ নৌপথ মুক্ত করতে সহায়তা করে। বাইরের দেশের সাথে বাণিজ্য করতে বন্দরকে কার্যকর করার কাজ এভাবেই শুরু হয়। এছাড়াও সোভিয়েতের অর্থনৈতিক সহায়তায় ঘোড়াশালে ১১০ মেগাওয়াটের তাপ-বিদ্যুত কেন্দ্র এবং সারাদেশে আটটি রেডিও স্টেশন নির্মাণের কাজ শুরু হয়।

সব মিলিয়ে ১৯৭২ সালের শুরুর দিকেই প্রাপ্ত বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ ছিল ৬১২ মিলিয়ন ডলার, ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের পুরোটার হিসেবে বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ ছিল ৮৮৬ মিলিয়ন ডলার। খাদ্য সমস্যা সমাধানে হাত বাড়িয়ে দেয় বিভিন্ন দেশ, ৭২ সালে বিদেশ থেকে আসে তিন মিলিয়ন টন ধান আর গম।

তবে দেশজুড়ে সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল আইন শৃঙ্খলা সমস্যা। মুক্তিযুদ্ধের সময় নিয়মিত বাহিনী ছাড়াও সাধারণ মানুষের সহায়তায় গড়ে উঠেছিল গণবাহিনী। গণবাহিনীতে ছিলেন সাধারণ কৃষক, মধ্যবিত্ত চাকুরে, দিনমজুর, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র। সব মিলিয়ে এই গণবাহিনীর সংখ্যা ছিল ৮৪ হাজার।

গণবাহিনীর বাইরে ছিল মুজিববাহিনী, এদের সংখ্যা ছিল দশ হাজার। এদের সবার হাতেই কম বেশি অস্ত্র ছিল, সবার ছিল যুদ্ধ করার ট্রেনিং। তথ্য উপাত্ত ঘেঁটে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ছিল এক লাখ পঞ্চাশ হাজারের মতো আগ্নেয়াস্ত্র। এছাড়াও পাকিস্তানি বাহিনীর কাছ থেকে লুটকৃত অস্ত্র গোলাবারুদের পরিমাণও কম ছিল না। মুক্তিযোদ্ধা বাদেও রাজাকার, আল বদর, আল শামস, বিহারীদের কাছেও অস্ত্র আর গোলাবারুদ ছিল। নতুন দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল খুবই নাজুক।

শেখ মুজিবুর রহমানের দেশে ফিরে আসার পর তার ডাকে সাড়া দিয়ে অনেকেই অস্ত্র জমাদান শুরু করেন। তবে ঝামেলা বাঁধে অতি বামপন্থী আর রাজাকারসহ বিহারীদের নিয়ে। অতি বামপন্থীদের একাংশ তাদের হাতে থাকা অস্ত্র জমাদানে আগ্রহী ছিল না, তাদের মতে বাংলাদেশে বিপ্লব অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে, এবং এই ধারণা থেকে অনেকেই সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে যায়।

ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘মর্নিং নিউজ’ এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিশ মাসে রাজনৈতিক কারণে ছয় হাজারের বেশি অপরাধ সংগঠিত হয়েছিল। সশস্ত্র হামলা, ডাকাতির সংখ্যা দেশজুড়ে বৃদ্ধি পায়। নতুন দেশে চাওয়া পাওয়ার মিল না হওয়া, খাদ্যের অভাব, চাকরি আর কর্মসংস্থানের অভাবে তরুণ আর মধ্যবয়স্ক অনেকেই অপরাধে জড়িয়ে যায়, মুক্তিযুদ্ধের পরে স্বজন হারানো বিপুল সংখ্যক মানুষের মানসিক সমস্যাও প্রকট আকার ধারণ করে, যার হিসেব কাগজে কলমে কোনোদিন লিপিবদ্ধ হয়নি।

অন্যদিকে বাংলাদেশে থাকা পাঁচ লাখ বিহারীদের নিয়ে সরকার পড়ে বিপাকে। ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের কৃষি একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, তবে কালোবাজারি, চোরাচালানের ফলে তার সুফল পাওয়া হয়নি দেশবাসীর। দেশের নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দেশে গড়ে উঠে চোরাকারবারি চক্র। সব মিলিয়ে দেশের মানুষের উপর ভয়াবহ অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি হয়।

স্বাধীন দেশ প্রাকৃতিক আর ভৌগলিক কারণেও কম হোঁচট খায়নি। ১৯৭৪ সালের বন্যা দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। একদিকে বাংলাদেশের জটিল রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে চলছে ভাঙা গড়ার লড়াই। অন্যদিকে বাংলাদেশের ১৭ থেকে ১৯টি জেলা প্লাবিত হয়ে লাখ লাখ মানুষের ভোগান্তি শুরু হয়। নতুন দেশের রাস্তাঘাট নতুন করে নির্মাণের কাজ বিভিন্ন জায়গায় যতদূর হয়েছিল তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন এলাকায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, সরকারি তথ্য অনুসারেই ১৯৭৪ সালের নভেম্বরের দুর্ভিক্ষে সাড়ে সাতাশ হাজার মানুষ মারা যায়।

মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে ছিল এক ভগ্নস্তূপে। দেশের সর্বত্রই পাক হানাদার বাহিনীর রেখে যাওয়া ধ্বংসস্তুপ, দেশে লক্ষ লক্ষ তরুণ বেকার, অনেকের হাতেই গোলাবারুদ আর অস্ত্র, অনেকেই পঙ্গু কিংবা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। হাজারো লক্ষ মানুষের বুকে স্বজন হারানোর বেদনা, নয়মাস শরনার্থী শিবিরে কাটিয়ে আসা মানুষের এক মুঠো ভাতের জন্য হাহাকার। এরমধ্যেও একদল সুযোগ সন্ধানী মানুষের লুটতরাজের চেষ্টা চারিদিকে। ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৭৪ সালের মে মাসের মধ্যেই দেশে ৯ হাজার ৫৪০টি খুন আর ১২ হাজার ২৪৪টি রাহাজানির ঘটনা সরকারি সূত্র থেকেই জানা যায়।

জাতীয় রাজনীতিতে নানা পরিবর্তনে বেদনাবিধুর সেই সময় আমরা অনেক পেছনে ফেলে এসেছি। পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশ আর তার অর্থনীতির যাত্রা এখন শুধুই সামনের দিকে। একদম কবির কবিতার মতো করেই ধ্বংসস্তুপে আমরা ফুল ফুটিয়েছি।

বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় উঠে আসে জন্মের পঞ্চাশ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে কীভাবে বাংলাদেশ দ্রুতগতি সম্পন্ন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট এক উৎক্ষেপণের মতো সফলতা দেখিয়েছে। উঠে আসে জাতির পিতা কীভাবে পুরো জাতিকে স্বাধীনতার জন্য একতাবদ্ধ করেছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ থেকে কীভাবে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত হতে যাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্ব, দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা, কৃষি, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানীমূখী শিল্পায়ন, একশোটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, পোশাক শিল্প, ঔষধ শিল্প, রপ্তানী আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, ঢাকার মেট্রোরেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পসমূহ দেখলেই বোঝা যায় উন্নয়নের মহাসড়কে রয়েছে বাংলাদেশ।

ক্ষুদ্র আয়তনের একটি উন্নয়নশীল দেশ হয়েও বাংলাদেশ ইতোমধ্যে সারা বিশ্বের নিকট প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিবিড় সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবহার এবং দারিদ্র দূরীকরণে তার ভূমিকা, জনবহুল দেশে নির্বাচন পরিচালনায় স্বচ্ছ ও সুষ্ঠুতা আনয়ন, বৃক্ষরোপণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকের ইতিবাচক পরিবর্তন প্রভৃতি ক্ষেত্রে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে জন্ম নেয়া এই বাংলাদেশকে আজকের অবস্থানে আসতে অতিক্রম করতে হয়েছে হাজারো প্রতিবন্ধকতা। যুদ্ধ বিধ্বস্ত, প্রায় সর্বক্ষেত্রে অবকাঠামোবিহীন সেদিনের সেই সদ্যজাত জাতির বর্তমান অর্জনের পরিসংখ্যানও নিতান্ত অপ্রতুল নয়।

সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার আটটি লক্ষ্যের মধ্যে শিক্ষা, শিশুমৃত্যু হার কমানো এবং দারিদ্র হ্রাসকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য উন্নতি প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছে।

শিক্ষাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের নেয় পদক্ষেপ গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- শতভাগ ছাত্রছাত্রীর মাঝে বিনামূল্যে বই বিতরণ কার্যক্রম। নারী শিক্ষাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত চালু করা হয়েছে উপবৃত্তি ব্যবস্থা।

বর্তমান ছাব্বিশ হাজার একশো তিরানব্বইটি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে নতুন করে জাতীয়করণ করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষকের চাকরি সরকারীকরণ করা হয়েছে। উনিশো নব্বই সালে বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিশুর শতকরা হার ছিল একষট্টি, বর্তমানে তা উন্নীত হয়েছে শতকরা সাতানব্বই দশমিক সাত ভাগে।

শিক্ষার সুবিধাবঞ্চিত গরিব ও মেধাবী ছাত্র ছাত্রীদের শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট আইন, দুই হাজার বারো প্রণয়ন করা হয়েছে, গঠন করা হয়েছে ‘শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট।’

শিশুদের টিকাদান কর্মসূচির সাফল্যের জন্য এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম আদর্শ দেশ হিসেবে তার স্থান করে নিয়েছে। স্বাস্থ্যখাতকে যুগোপযোগী করতে প্রণয়ন করা হয়েছে ‘জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিমালা- ২০১১।’ তৃণমূল পর্যায়ের দরিদ্র মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গড়ে তোলা হয়েছে বারো হাজার সাতশো উনআশি টি কমিউনিটি ক্লিনিক। তিনশো বারটি উপজেলা হাসপাতালকে উন্নীত করা হয়েছে পঞ্চাশ শয্যায়। মেডিকেল কলেজ ও জেলা হাসপতালগুলোতে দুই হাজার শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে।

মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার এবং জন্মহার হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। উনিশো নব্বই সালে নবজাতক মৃত্যুর হার একশো উনপঞ্চাশ থেকে নেমে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে তিপান্নতে। স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবার লক্ষ্যকে সামনে রেখে নির্মাণ করা হয়েছে নতুন বারোটি মেডিকেল কলেজ, নিয়োগ দেয়া হয়েছে সাতচল্লিশ হাজারেও বেশি জনশক্তি।

নারীর সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা- ২০১১।’ সমাজের প্রতিটি স্তরে নারী অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করতে গৃহীত হয়েছে নানামুখী পদক্ষেপ।

প্রযুক্তি জগতে নারীদের প্রবেশকে সহজ করতে ইউনিয়ন ডিজিটাল কেন্দ্রের মতো ইউনিয়ন ভিত্তিক তথ্যসেবায় উদ্যোক্তা হিসেবে একজন পুরুষের পাশাপাশি নিয়োগ দেয়া হয়েছে একজন নারী উদ্যোক্তাকেও।

‘জাতীয় শিশু নীতি-২০১১’ প্রণয়নের মাধ্যমে সুরক্ষিত করা হয়েছে শিশুদের সার্বিক অধিকারকে। দেশের চল্লিশটি জেলার সদর হাসপাতাল এবং বিশটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্থাপন করা হয়েছে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেল।

দুঃস্থ, এতিম, অসহায় পথ শিশুদের সার্বিক বিকাশের জন্য স্থাপন করা হয়েছে পনেরটি শিশু বিকাশ কেন্দ্র। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের নারী ও শিশুর উন্নয়নে ভূমিকা রাখার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভূষিত করা হয়েছে জাতিসংঘের সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ডে।

নারী বঞ্চনার তিক্ত অতীত পেরিয়ে বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে অনেকদূর এগিয়েছে। পোশাকশিল্পে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ দেশ। আর এই শিল্পের সিংহভাগ কর্মী হচ্ছে নারী।

ক্ষুদ্রঋণ বাংলাদেশে গ্রামীণ উন্নয়নে ও নারীর ক্ষমতায়নে অভূতপূর্ব অবদান রেখেছে। আর ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের মধ্যে আশি শতাংশের এর উপর নারী। বাংলাদেশ সরকার নানাভাবে নারী উদ্যোক্তাদের অনুপ্রেরণা দিয়ে এসেছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবতায় রূপ দিতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকার নিয়েছে যুগান্তকারী সব পদক্ষেপ।

দেশের তৃণমূল পর্যায়ে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি সেবা পৌঁছে দেয়ার অভিপ্রায়ে দেশের চার হাজার পাঁচশো পঞ্চাশটি ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। তৈরি করা হয়েছে বিশ্বের অন্যতম বিশাল ন্যাশনাল ওয়েব পোর্টাল।

কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত এ পোর্টালের সংখ্যা প্রায় পঁচিশ হাজার। দেশের সবকটি উপজেলাকে আনা হয়েছে ইন্টারনেটের আওতায়।

টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে বর্তমানে বাংলাদেশে মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যা বারো কোটি সাইত্রিশ লাখ এবং ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা চার কোটি ছেচল্লিশ লাখে উন্নীত হয়েছে।

সেবা প্রদান প্রক্রিয়া সহজ ও স্বচ্ছ করতে চালু করা হয়েছে ই পেমেন্ট ও মোবাইল ব্যাংকিং। সরকারী ক্রয় প্রক্রিয়া অনলাইনে সম্পাদন করার বিষয়টিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়েছে। ফোর জি প্রযুক্তির মোবাইল নেটওয়ার্কের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। ফাইভ জি এর প্রক্রিয়া চলছে।

কৃষিখাতে অভূতপূর্ব কিছু সাফল্যের জন্য বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ বারবার আলোচিত হয়েছে। প্রায় ষোল কোটি জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশ বর্তমানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় পঞ্চাশ লাখ মেট্রিক টন।

প্রধানমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রীর সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম আবিষ্কার করেছেন পাটের জিনোম সিকুয়েন্সিং। সারা বিশ্বে আজ পর্যন্ত মাত্র সতোরটি উদ্ভিদের জিনোম সিকুয়েন্সিং হয়েছে, তার মধ্যে ড. মাকসুদ করেছেন তিনটা। তাঁর এই অনন্য অর্জন বাংলাদেশের মানুষকে করেছে গর্বিত।

বর্তমানে বিশ্বের একশো সাতান্নটি দেশে বাংলাদেশের ছিয়াশি লাখেরও অধিক শ্রমিক কর্মরত আছে। বিদেশে শ্রমিক প্রেরণ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ স্থাপন করেছে অনন্য দৃষ্টান্ত।

স্বল্প সুদে অভিবাসন ঋণ প্রদানের লক্ষ্যে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক স্থাপন করে দেশের সাতটি বিভাগীয় শহরে এর শাখা স্থাপন করা হয়েছে। এই ব্যাংকের মাধ্যমে এপ্রিল দুই হাজার চৌদ্দ পর্যন্ত বিশ কোটি পঞ্চাশ লাখ টাকা অভিবাসন ঋণ বিতরণ করা হয়েছে।

তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে সারাদেশে তৃণমূল পর্যায় থেকে বিদেশ গমনেচ্ছু জনগণকে রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণকেও এ সেবা গ্রহণের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে হয়রানি ছাড়াই স্বল্প ব্যয়ে মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশগুলোতে শ্রমিকরা যেতে পেরেছে।

১৯৮০ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তি মিশনে যোগদানের পর এ পর্যন্ত বিশ্বের উনচল্লিশটি দেশের চোষট্টিটি শান্তি মিশনে খ্যাতি ও সফলতার সাথে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এ যাবৎকালে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী একশো পনেরটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বাগ্রে।

বিদ্যুৎখাতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্জনের মধ্যে রয়েছে জাতীয় গ্রিডে অতিরিক্ত ছয় হাজার ৩২৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সংযোজন, যার ফলে বিদ্যুতের সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৪৭ শতাংশ থেকে বাষট্টি শতাংশে উন্নীত হয়েছে। একই সাথে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ২২০ কিলোওয়াট ঘণ্টা থেকে বেড়ে ৩৪৮ কিলোওয়াট ঘণ্টায় দাঁড়িয়েছে। নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান করা হয়েছে ৩৫ লক্ষ গ্রাহককে। নির্মাণ করা হয়েছে নতুন ৬৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র।

বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের পাশাপাশি প্রসার ঘটেছে আবাসন, জাহাজ, ওষুধ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ খাদ্য শিল্পের। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের তালিকায় যোগ হয়েছে জাহাজ, ওষুধ এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যসামগ্রী।

বাংলাদেশের আইটি শিল্প বহির্বিশ্বে অভূতপূর্ব সুনাম কুড়িয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের আইটি শিল্প দশ কোটি মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় ছাড়িয়ে গেছে।

সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাংলাদেশের অর্জন হতদরিদ্রদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি বিস্তৃত করতে বয়স্ক, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত ও দুঃস্থ মহিলা ভাতা, অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃকালীন ভাতাসহ ভাতার হার ও আওতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা হয়েছে।

২০০৮-০৯ সালে এই খাতে মোট বরাদ্দ ছিল তেরো হাজার আটশো পয়তাল্লিশ কোটি টাকা, বর্তমানে এ কার্যক্রমে বরাদ্দের পরিমাণ পঁচিশ হাজার তিনশো একাত্তর কোটি টাকা। খানা আয় ব্যয় জরিপ, ২০১০ এর সমীক্ষায় দেখা গেছে মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৪.৫ শতাংশ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতাভুক্ত হয়েছে।

ভূমি ব্যবস্থাপনাকে আধুনিকায়ন করতে পঞ্চান্নটি জেলায় বিদ্যমান মৌজা ম্যাপ ও খতিয়ান কম্পিউটারাইজেশনের কাজ সম্পন্ন করার কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। ভূমির পরিকল্পিত ও সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে মোট একুশটি জেলার একশো বায়ান্নটি উপজেলায় ডিজিটাল ল্যান্ড জোনিং ম্যাপ সম্বলিত প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রণীত হয়েছে ‘কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন, ২০১২ এর খসড়া।’

মন্দার প্রকোপে বৈশ্বিক অর্থনীতি যখন বিপর্যস্ত ছিল বাংলাদেশ তখন বিভিন্ন উপযু্ক্ত প্রণোদনা প্যাকেজ ও নীতি সহায়তার মাধ্যমে মন্দা মোকাবেলায় সক্ষমই শুধু হয়নি, জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ছয় বেশি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।

বিশ্ব অর্থনীতির শ্লথ ধারার বিপরীতে আমদানি রপ্তানি খাতে প্রবৃদ্ধি বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে রেমিট্যান্সের পরিমাণ। ঋণ পরিশোধে সক্ষমতার মানদণ্ডে ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামের সমকক্ষতা অর্জিত হয়েছে।

বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের সু্যোগ অনেক। সাম্প্রতিককালে, বাংলাদেশ সরকার বেসরকারি বিনিয়োগে একটি সহায়ক ও প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নীতির ক্ষেত্রে বেশ কিছু পুরাতন ব্যবসার সংস্কার করেছে।

বেসরকারি বাণিজ্য খাতের প্রবল আগ্রহের কারণেই বাংলাদেশ বাজার অর্থনীতি প্রবর্তনে দ্রুত বিভিন্ন কার্যকরী প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করে। তাই বিনিয়োগ ও টেকসই উন্নয়নের জন্য সহায়ক স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজমান।

ইতোমধ্যেই একটি মাঝারি মানের কিন্তু সুষম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক নীতির মূল ভিত্তি হলো সম্পদের উৎপাদন ও বণ্টনে প্রতিযোগিতামূলক বাজার অর্থনীতির ওপর আস্থা এবং বেসরকারি খাতের ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দূর করা।

সরকার ধাপে ধাপে শিল্প ও অবকাঠামোগত ক্ষেত্রে নিজের সম্পৃক্ততা সরিয়ে বেসরকারি অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করছে। অর্থনৈতিক নীতিসমূহের ক্ষেত্রে সরকার দ্রুত সুনির্দিষ্ট সংস্কার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে এবং সবার জন্য উন্মুক্ত বিনিয়োগ নীতি প্রণয়ন করেছে। এক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা অনুঘটকের, কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রকের নয়। নিয়ন্ত্রণ ও বিধিনিষেধকে ন্যূনতম একটি পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে।

সরকার সুষম গতিতে বাণিজ্য ক্ষেত্রে উদারীকরণ করেছে। শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা, যৌক্তিক শুল্ক নির্ধারণ এবং রপ্তানী সুবিধা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অর্জন সাধিত হয়েছে। শিল্পহার কাঠামো ও আমদানি নীতির বিভিন্ন দিক সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

টেক্সটাইল, চামড়াজাত সামগ্রী, ইলেকট্রনিক্স দ্রব্য, রাসায়নিক ও পেট্রো কেমিক্যাল, কৃষি ভিত্তিক শিল্প, কাঁচা পাট, কাগজ, রেশম শিল্প, হিমায়িত খাদ্য বিশেষত চিংড়ি, পর্যটন, কৃষি, ক্ষুদ্র শিল্প, সফটওয়্যার ও ডাটা প্রসেসিং এর মতো রপ্তানীমুখী শিল্পে বিদেশি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এছাড়াও ভারী ও তথ্য প্রযুক্তির শিল্প প্রতিষ্ঠায়ও বিদেশি বিনিয়োগকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে যা দেশীয় আমদানি ব্যয় কমাতে সাহায্য করবে।

বাংলাদেশের কিছু বিদেশি বিনিয়োগ সুবিধা হলো- একশো ভাগ সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ডিএফআই অথবা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকাতে ইপিজেড যৌথ বিনিয়োগ অথবা এ এলাকার বাইরের বিনিয়োগ। স্টক এক্সচেঞ্জ এর মাধ্যমে পাবলিক কোম্পানির শেয়ার ক্রয়ের দ্বারা তালিকাভুক্ত বিনিয়োগ।

অবকাঠামোগত প্রকল্পে বিনিয়োগ যেমন বিদ্যুৎ খাত, তেল, গ্যাস ও খনিজ অনুসন্ধান, টেলিযোগাযোগ, বন্দর, সড়ক ও জনপথ। সরাসরি প্রত্যক্ষ ক্রয় অথবা সরকারি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ক্রয় করা বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়াধীন কোনো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার এবং বেসরকারি ইপিজেড বিনিয়োগ।

বেসরকারি উদ্যোগে রপ্তানিমুখী ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প প্রতিষ্ঠায় দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সব ধরনের সেবা প্রদানের জন্য বিনিয়োগ বোর্ড দায়িত্বপ্রাপ্ত। সব ধরনের বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ ও ব্যবসা সহায়তা প্রদান করা এই বোর্ডের মূল লক্ষ্য। সরকার প্রধানের নেতৃত্বে পরিচালিত এ বোর্ডে বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সচিবালয় এবং বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিনিধিরা সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে দ্রুত গতিশীল করতে বিশেষত শিল্পায়নকে শক্তিশালী করতে সরকার বিদেশি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতে একটি উন্মুক্ত নীতি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ কর্তৃপক্ষ বেপজা দেশের রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকায় বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা ও শিল্প স্থাপনে বিভিন্ন সহায়তা প্রদানে দায়িত্ব পালন করছে।

বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পেরেছে এবং তাদের আস্থা অর্জনে সফল হয়েছে। গত চার বছরে ডিজিটাল অর্থনীতিতে চমকপ্রদ অগ্রগতি অর্জন করে হুয়াওয়ের গ্লোবাল কানেক্টিভিটি ইনডেক্স ২০১৯ এর টপ মুভার তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ। তালিকায় থাকা বাকি তিন দেশ হচ্ছে ইউক্রেন, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং আলজেরিয়া।

সরকারের উন্নয়ন মহাযজ্ঞে যে ১০ টি উন্নয়ন মহাপ্রকল্প রয়েছে সেগুলো সম্পর্কে জানা দরকার। এগিয়ে চলছে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হাতে নেওয়া সরকারের দশ প্রকল্পের কাজ। এগুলো হলো পদ্মাসেতু প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেট্রোরেল, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা সমুদ্র বন্দর, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, এলএনজি টার্মিনাল, ঘুমধুমে ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগ’ খাত দশ প্রকল্প বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। রূপকল্প একুশ সামনে রেখে এসব প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন হলে দেশের আর্থ সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে নতুন মাইলফলক রচিত হবে বলে মনে করছে সরকারসহ সংশ্লিষ্টরা।

দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে শেখ হাসিনার দৃঢ় অঙ্গীকার ও বিভিন্ন গণমুখী উদ্যোগের মধ্যে এই দশ ক্ষেত্রকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গভর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

এছাড়া ভারত, চীন, জাপান ও কোরিয়ার বিনিয়োগ বাড়াতে ওই দেশগুলোর জন্য পৃথক অর্থনৈতিক অঞ্চল সংরক্ষণ করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে আগামী পনের বছরে সারাদেশে আরো একশোটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হবে। এর ফলে দেশের রফতানি আয় বৃদ্ধি পাবে অতিরিক্ত চল্লিশ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে প্রায় এক কোটি মানুষের।

আরও পড়ুন- বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধার হচ্ছে: এডিবি

এরকম হাজারো প্রকল্প ও উদ্যোগের মতো এই সরকারের চারবারের উন্নয়নের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় তার কাজ আর দেশের জন্যে নিজের জীবন ও পরিবারের জীবন বিলিয়ে দেয়ার ঋণের দায় বাঙালি জাতি কী কোনদিন শোধ করতে পারবে? এমন প্রশ্নই এখন সকলের মুখে মুখে। তবুও ডিজিটাল দেশ আর মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন ও সমুদ্র সীমা জয় করে ব্লু ইকনোমির মাধ্যমে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় মুজিববর্ষে বাংলাদেশ।

ভয়েসটিভি/এএস/ডিএইচ

 

 

 

You may also like